সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় গ্রেপ্তার কুমিল্লার আবু সোলাইমান মো. সোহেলের বোন উপজেলা সহকারী শিক্ষা অফিসার। আর ভাবি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক। স্থানীয়দের অভিযোগ, সোহেলের ফাঁস করা প্রশ্নপত্রেই চাকরি হয়েছে তাদের। তবে এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন বোন ও ভাবি। এলাকায় নিজেকে কখনো প্রপার্টি ডেভেলপার কখনো গার্মেন্টস ব্যবসায়ী পরিচয় দিতেন সোহেল। গত ১৫ বছরে নিজ এলাকায় ৩০-৩৫ বিঘা জমি কিনেছেন। ঢাকা থেকে যখন বাড়িতে আসতেন, তখন একা একা চলাফেরা করতেন। কারও সঙ্গে তেমন মেলামেশা করতেন না। হঠাৎ প্রশ্নফাঁসে তার গ্রেপ্তারের খবরে অবাক হয়েছেন সবাই।
সোহেল (৩৫) কুমিল্লার আদর্শ সদর উপজেলার আমড়াতলী ইউনিয়নের বানাশুয়া গ্রামের আব্দুল ওহাবের ছেলে। তিন ভাই ও দুই বোনের মধ্যে সবার ছোট। বানাশুয়া প্রাইমারি স্কুলে পড়াশোনা করে কুমিল্লা জিলা স্কুল ও পরে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। সপরিবারে রাজধানীর মিরপুরে থাকেন। সরেজমিনে সোহেলের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, একতলা ভবনের একটি বাড়ি খালি পড়ে আছে। তার বড় দুই ভাই স্বর্ণ ব্যবসায়ী। এক বোন হালিমা বেগম উপজেলা সহকারী শিক্ষা অফিসার। অপর বোন লাকি বেগম যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী। তার কাছেই থাকেন সোহেলের বাবা-মা।
বানাশুয়া ও পার্শ্ববর্তী শিমরা গ্রামের কয়েকজন বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সোহেলের বাবা আব্দুল ওহাব এলাকায় ওহাব বিএসসি নামে পরিচিত। তিনি সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষ। পৈতৃক সূত্রে পাওয়া কিছু জমিজমা লোক দিয়ে চাষাবাদ করে জীবনযাপন করতেন। তবে গত জুন মাসে তিনি দেড় কোটি টাকা মূল্যের জমি ক্রয় করেন। জানা যায়, সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার পদে চাকরি পেয়ে আর কোনো পরীক্ষায় অংশ নেননি সোহেলের বোন হালিমা। এরপর থেকে ১০ বছর ধরে এই পদেই চাকরি করছেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, সোহেলের বোন হালিমা বেগম উপজেলা সহকারী শিক্ষা অফিসার। তিনি ২০১৪ সালের ২৯ জানুয়ারি চাকরি পেয়েছেন। জীবনে ৩টি চাকরির পরীক্ষার আবেদন করেছিলেন। অংশ নিয়েছিলেন দুটিতে। একটি বিসিএস। তবে প্রিলিতেও পাস করতে পারেননি। আরেকবার ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষায় আবেদন করলেও পরীক্ষা বাতিল হয়ে যায়। এরপর পরীক্ষা দেন পিএসসির সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার পদে। জীবনের দ্বিতীয় পরীক্ষায় করেন বাজিমাত। যদিও এটি জীবনের প্রথম পরীক্ষা না কি দ্বিতীয় হালিমাও নিজেও তা জানেন না। সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার পদে চাকরি পেয়ে আর কোনো পরীক্ষায় অংশ নেননি। বর্তমানে মুরাদনগর উপজেলায় কর্মরত আছেন।
চাকরি পাওয়ার অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে হালিমা বেগম বলেন, ‘আমার ভাইয়ের প্রশ্নে আমি পরীক্ষা দিইনি। আমার পরীক্ষা পিএসসি নিয়েছিল। নিজ যোগ্যতায় পাস করেছি। যদিও বিসিএস প্রিলিতে আমি পাস করতে পারিনি। ভাইয়ের এসব বিষয়ের জড়িত থাকার কথা বিশ্বাস হয় না। কারণ ভাই তিনবার বিসিএস পরীক্ষা দিয়েছে। যদি প্রশ্ন পেত তাহলে তো চাকরি হতো। কোনোবার পাস করেনি। সে তো চাকরি নেয়নি। মানে প্রশ্ন ফাঁস করতে পারে না।’
৩০-৩৫ বিঘা জমি কেনার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা আগে থেকে ধনী। আমাদের টাকা-পয়সার অভাব ছিল না। শেষ দিকে শুনেছি সোহেল ভালো ব্যবসা করে। আমার অন্য ভাইদের কাছ থেকেও টাকা নিয়েছিল। সোহেল শেয়ার, বন্ড, বিল্ডার্স, ল্যান্ডসহ বিভিন্ন ব্যবসা করতো। অনেক আগে আমার কাছ থেকে ১০ লাখ টাকা ধার নিয়েছিল। তিন মাস আগে সেটা ফেরত দিয়েছে। আমার ভাই ভালো মানুষ। কে জানি আমাদের সর্বনাশ করলো, বুঝতেছি না।’
অপরদিকে বড় ভাই মো. সুজনের স্ত্রী (সোহেলের ভাবি) নাজনিন সুলতানা পলি স্থানীয় মহিষমারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক। ২০১১ সালের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে আবেদন করে ২০১২ সালে পরীক্ষা দেন। ২০১৪ সালে চাকরিতে প্রবেশ করে ২০১৭ সালে আসেন মহিষমারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এর আগে ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলায় একই পদে কর্মরত ছিলেন। নাজনিন সুলতানা পলি বলেন, ‘দেবরের প্রশ্নে পরীক্ষায় পাস করিনি। আমার যোগ্যতায় চাকরি পেয়েছি। এই চাকরি ছাড়া তেমন কোনো চাকরির পরীক্ষায় অংশ নেইনি। সোহেল প্রশ্নফাঁস করে দিলে তো আরও ভালো চাকরি করতাম। আমি ভালো স্টুডেন্ট ছিলাম। আরও ভালো চাকরি পাওয়া দরকার ছিল।’
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মো. সফিউল আলম বলেন, ‘বিষয়টি খুবই গোপনীয়। এ বিষয়ে আমাদের কী করার আছে? যদি সত্যি হয় তাহলে অবশ্যই আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এতে আমাদের সহযোগিতা লাগলে আমরা প্রস্তুত আছি’। পরিবার ও স্থানীয়দের মাধ্যমে জানা যায়, কুমিল্লার ছাতিপট্টিতে ও বুড়িচংয়ে দুটি স্বর্ণের দোকান আছে সোহেলের পরিবারের। বড় ভাই সুজন স্বর্ণের দোকানের দেখাশোনা করেন আর মেজো ভাই মো. খালেদ দেখেন গ্রামের কৃষিজমি। মাঝেমধ্যে ব্যবসাও দেখেন।
স্থানীয়রা বলছেন, স্বর্ণের দোকান, কৃষি থেকে আয় সবই লোক দেখানো। এগুলো এত সম্পদ কেনার উৎস হতে পারে না। সোহেলের প্রতিবেশী মাসুদ রানা জানান, গত ১৫ বছরে সোহেলদের পরিবার তাদের বাড়ির উত্তর দিকে রেললাইন পর্যন্ত মাঠে প্রায় ৩০ বিঘা জমি কিনেছে। কিছুদিন আগে সোহেল আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল হানিফের কাছ থেকে বাড়িসংলগ্ন পশ্চিম পাশে দেড় কোটি টাকায় দেড় বিঘা জমি কিনেছেন।
দেড় কোটি টাকা দিয়ে জমি কেনার বিষয়ে জানতে চাইলে বিক্রেতা মো. আব্দুল হানিফ বলেন, ‘জায়গাটি আমাদের পৈতৃক। গত জুন মাসে সোহেলের বাবা ওহাব বিএসসি জায়গাটি কিনেছেন। তবে এখনও পুরো টাকা দেননি। তিনি আমেরিকা থেকে ফিরলে বাকি টাকা দেবেন বলেছেন।’ আমড়াতলী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান কাজী মোজাম্মেল হক বলেন, ‘সোহেলের পরিবার এলাকায় স্বর্ণ জমা রেখে সুদের ব্যবসা করতো। শহরের কাপড়িয়াপট্টিতে তাদের জুয়েলারি দোকানটা সাদামাটা। তাদের এত সম্পদ অর্জনের সঙ্গে আয়ের তেমন মিল নেই। টিভিতে তার সম্পর্কে জানতে পেরে অবাক হয়েছি।’