উপমহাদেশের বরেণ্য রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা ভারতের চতুর্থ সর্বোচ্চ বেসামরিক ‘পদ্মশ্রী’ পদক গ্রহণ করেছেন। গত সোমবার সন্ধ্যায় দিল্লিতে ভারতের রাষ্ট্রপতি ভবনে দেশটির রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর হাত থেকে পদ্মশ্রী পুরস্কার নেন তিনি। রবীন্দ্রসংগীতের ক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের জন্য তাঁকে এ সম্মাননা দিয়েছে ভারত সরকার। এদিন অনুষ্ঠানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহও উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানেঅনেক ভিড়ের মধ্যে যখন নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার দেখা হয়, তখন নরেন্দ্র মোদি তাঁকে প্রশ্ন করেন, ‘আপ ক্যায়সে হ্যায়?’ [আপনি কেমন আছেন?]। এ সময় তাদের মধ্যে কুশল বিনিময় হয়। পরে ভারতের প্রেসিডেন্টের অফিসিয়াল এক্স হ্যান্ডল থেকে পুরস্কারপ্রাপ্তদের নিয়ে পৃথক পোস্ট করা হয়। বাংলাদেশে রবীন্দ্রসংগীতে নিবেদিতপ্রাণ উল্লেখ করে শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার অবদানের কথা তুলে ধরা হয়।
সেই সঙ্গে মহাত্মা গান্ধীর ১৫০তম জন্মদিনে বন্যার কণ্ঠে গাওয়া ভজন‘বৈষ্ণব জন তো তেনে কাহিয়ে’র কথাও স্মরণ করা হয় পোস্টে। এদিকে পদ্মশ্রী পদক পেয়ে উচ্ছ্বসিত বন্যা। পুরস্কার পেয়ে বন্যা বলেন, ‘যে কোনো প্রাপ্তি আনন্দের। পদ্মশ্রীর মতো পুরস্কার পেয়ে খুব ভালো লাগছে। আমি খুবই রোমাঞ্চিত, আনন্দিত এবং সম্মানিত বোধ করছি। বাংলাদেশের একজন নাগরিক হিসেবে পুরস্কারটি আমার কাছে ভীষণ গর্বের। শুধু রবীন্দ্রসংগীত নয়; আমাকে সংগীতের জন্য দেওয়া হয়েছে এই পুরস্কার। আমার জন্য ভালো লাগার ব্যাপার যেমন, তেমনি অন্যরাও ভীষণ অনুপ্রাণিত হবে। বাংলাদেশের সংগীতাঙ্গনে এখন দারুণ সব কাজ হচ্ছে। নতুন নতুন ছেলেমেয়েরা আসছে গানের জগতে।’ বন্যা আরও বলেন, ‘পদ্মশ্রী পুরস্কার প্রাপ্তির পর বাংলাদেশ থেকে অনেকেই ফোনে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। দেশের অনেক লোক এখানে বসবাস করেন। তাদের অনেকেই অভিনন্দন জানাচ্ছেন। এ ভালোবাসাভোলার নয়। মনটা আনন্দে ভরে গেছে। সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।’
বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য এ বছর পাঁচ গুণী ব্যক্তিকে পদ্মবিভূষণ, ১৭ জনকে পদ্মভূষণ ও ১১০ জনকে পদ্মশ্রী পুরস্কারে ভূষিত করে ভারত সরকার। যার মধ্যে ছিলেন রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা। এর আগে ২০২১ সালে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের অগ্রণী ব্যক্তিত্ব অধ্যাপক সন্জীদা খাতুন এবং লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অবসরপ্রাপ্ত) সাজ্জাদ আলী জহির বীরপ্রতীককে পদ্মশ্রী পদকে ভূষিত করেছিল ভারত সরকার। তারও আগে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ও কূটনীতিবিদ সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী ‘পদ্মভূষণ’ সম্মাননা পেয়েছিলেন। আর ‘পদ্মশ্রী’ সম্মাননা পেয়েছিলেন প্রত্নতত্ত্ববিদ এনামুল হক ও সমাজকর্মী ঝর্ণাধারা চৌধুরী। শুধু পদ্মশ্রী নয়; ভারতের আরও কিছু পদক উঠেছে বন্যার ঝুলিতে। পেয়েছেন ‘বঙ্গভূষণ’ও। কলকাতার নজরুল মঞ্চেতাঁর হাতে এ সম্মাননা তুলে দেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি বিভাগ থেকে ২০১৩ সালে পেয়েছেন ‘সংগীত সম্মান পুরস্কার’।
রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার জন্ম ১৯৫৭ সালের ১৩ জানুয়ারি রংপুর জেলায়। বন্যা প্রথমে ছায়ানট, পরে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে সংগীত শিক্ষা ও পড়াশোনা করেছেন। পড়েছেন বুলবুল ললিতকলা একাডেমিতেও।রবীন্দ্রসংগীত ছাড়াও ধ্রুপদী, টপ্পা ও কীর্তনের ওপর শিক্ষা লাভ করেছেন।রবীন্দ্রসংগীত প্রচার ও প্রসারে ১৯৯২ সালে সংগীত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ‘সুরের ধারা’ প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। বর্তমানে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃত্য বিভাগের অধ্যাপক ও প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন। এর আগে তিনি একই বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা রবীন্দ্রসংগীত নিয়ে কয়েকটি বইও লিখেছেন। তিনি শান্তিনিকেতন থেকে রবীন্দ্রসংগীতের তালিম নেন।
শিক্ষাগুরু হিসেবে পেয়েছিলেন প্রখ্যাত শিল্পী কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, নীলিমা সেন, শৈলজারঞ্জন মজুমদার, শান্তিদেব ঘোষ, গোরা সর্বাধিকারী, মঞ্জু বন্দ্যোপাধ্যায়, অশেষ বন্দ্যোপাধ্যায়কে। সংগীতে অবদানের জন্য ২০১৬ সালে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক পদক ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’ পান তিনি। এ ছাড়া ফিরোজা বেগম স্মৃতি স্বর্ণপদক, সিটিসেল-চ্যানেল আই মিউজিক অ্যাওয়ার্ড, আনন্দ সংগীত পুরস্কারসহ বহু পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন গুণী এ কণ্ঠশিল্পী।