• বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:১৮ পূর্বাহ্ন
                               

পাকিস্তান দিবসেই দেশটির ‘জানাজা’ হয়ে যায়

রিপোর্টারঃ / ২২০ বার ভিজিট
আপডেটঃ শনিবার, ২৩ মার্চ, ২০২৪

২৩ মার্চ বঙ্গবন্ধু নিজ বাড়ীতে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন

মার্চ বাঙালি জাতির আত্মপরিচয়ের মাস, স্বাধীনতার মাস। প্রতিবাদ, প্রতিরোধ আর সংগ্রামের বীরত্বগাথা একাত্তরের অগ্নিঝরা মার্চের প্রতিদিনই যেন একেকটি রাজনৈতিক মহাকাব্য রচিত হয়েছে। ১ মার্চ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান কর্তৃক ৩ মার্চ অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণার প্রতিবাদে ২ মার্চ থেকে বাঙালির মুক্তির দূত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। প্রায় মাসব্যাপী একটানা অসহযোগ আন্দোলন ও ঘটে যাওয়া নানা ঘটনার মাঝে ঐতিহাসিক ৭ মার্চের পরে ২৩ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে আরেকটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ দিন। তখন বঙ্গবন্ধু-ইয়াহিয়া আলোচনা চলছিল। কিন্তু ২৩ মার্চ ইয়াহিয়ার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর কোনো বৈঠক হয়নি। তবে সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দীন আহমদসহ আওয়ামী লীগের একটি প্রতিনিধিদল প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা বিচারপতি এ আর কর্নেলিয়াস, লে. জেনারেল পীরজাদা, এম এ আহমেদ কর্নেল হাসানের সঙ্গে দুই দফায় দুই ঘণ্টা বৈঠক করেন। বৈঠকে আওয়ামী লীগ ৬ দফার ভিত্তিতে একটি খসড়া শাসনতন্ত্র উপস্থাপন করে।

দিন যত যেতে থাকে বঙ্গবন্ধু ঠিকই বুঝতে পারেন যে, আলোচনার নামে কালক্ষেপণ করা হচ্ছে এবং এতে কোনো ফল আসবে না। তাই তিনি আগেই ঘোষণা দিয়েছিলেন, একাত্তরের ২৩ মার্চ ‘পাকিস্তান দিবস’ নয়, পালিত হবে ‘প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে। পাশাপাশি তিনি ছাত্রলীগের তৎকালীন নেতৃবৃন্দকে নির্দেশ দিয়েছিলেন ২৩ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করতে। উল্লেখ্য, প্রতি বছর ২৩ মার্চ উদ্‌যাপিত হতো পাকিস্তান দিবস বা লাহোর প্রস্তাব দিবস হিসেবে। সেদিন চাঁদ-তারা খচিত পাকিস্তানের পতাকায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকত পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত, দোকানপাট এমনকি রাস্তাঘাটও। কিন্তু একাত্তরের ২৩ মার্চ বাংলাদেশে (তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান) সেই চিত্র সম্পূর্ণরূপে পাল্টে যায়। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ অনুযায়ী, ২৩ মার্চ বাংলাদেশে স্বতঃস্ফূর্তভাবে পালিত হয় প্রতিরোধ দিবস। ঢাকায় সচিবালয়, হাইকোর্ট, রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স, স্কুল-কলেজসহ সকল সরকারি, আধা-সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এমনকি ব্যক্তিগত বাসভবনেও স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলিত হয়। পাশাপাশি কালো পতাকাও ওড়ানো হয়। সেদিন ঢাকায় প্রেসিডেন্ট ভবন, গভর্নর হাউস, সেনানিবাস ও বিমানবন্দর ছাড়া কোথাও পাকিস্তানের পতাকা দেখা যায়নি।

সকালে আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর সদস্যদের সামরিক কায়দায় অভিবাদন গ্রহণ করেন এবং ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের নিজ বাসভবনে স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন মহাকালের মহানায়ক বাংলার অবিসাংবাদিত নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এ সময় সমবেত কণ্ঠে পরিবেশিত হয় ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’ গানটি। ভোর থেকেই ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’, ‘তুমি কে আমি কে, বাঙালি বাঙালি,’ ‘তোমার নেতা আমার নেতা, শেখ মুজিব, শেখ মুজিব’, ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান দিয়ে একের পর এক মিছিল নিয়ে বিভিন্ন পেশাজীবী, ছাত্র-শিক্ষকসহ সর্বস্তরের জনতা বঙ্গবন্ধুর বাড়ির সামনে জড়ো হতে থাকে। বঙ্গবন্ধু উপস্থিত জনতার উদ্দেশে বক্তব্য রাখেন। বাঁ হাতে স্বাধীন বাংলার পতাকা তুলে ধরে ডান হাত উঁচিয়ে জনতার উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘বাংলার মানুষ কারও করুণার পাত্র নয়। আপন শক্তির দুর্জয় ক্ষমতাবলেই তারা স্বাধীনতার লাল সূর্য ছিনিয়ে আনবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘বহু রক্ত দিয়েছি, প্রয়োজনবোধে আরও রক্ত দেব, কিন্তু মুক্তির লক্ষ্যে আমরা পৌঁছাবই। বাংলার মানুষকে আর পরাধীন করে রাখা যাবে না।’ এভাবেই সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি রাজনীতির মহাকবি বঙ্গবন্ধু সারা জীবন বাঙালির মুক্তির জন্য সংগ্রাম করেছেন। ঘুমন্ত জাতিকে জাগ্রত করেছেন, তাদেরকে যুদ্ধ ও চরম আত্মত্যাগের জন্য প্রস্তুত করেছেন। অবশেষে ২৬ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ২৩ মার্চ ‘প্রতিরোধ দিবস’ পালনের আড়ালে মূলত অঘোষিতভাবে ‘বাংলাদেশ দিবস’ পালন করা হয়। বাংলাদেশের সব জায়গা থেকে ‘পাকিস্তান দিবস’ মুছে গিয়েছিল প্রতিরোধের পতাকায়। এর মাধ্যমে সেদিনই পাকিস্তানের কফিনে শেষ পেরেকটি মেরে দেয় বাঙালিরা।

নিজ হাতে পতাকা উত্তোলন ছিল বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার পূর্ব সংকেত। কাজেই পাকিস্তান দিবসেই মূলত বাংলার মাটিতে পাকিস্তানের ‘জানাজা’ হয়ে যায়। এরপর নয় মাস রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের মাধ্যমে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটির দাফন সম্পন্ন হয় অর্থাৎ কবর রচিত হয়। তাই নির্দ্বিধায় বলা চলে, বাংলাদেশ যতদিন থাকবে, ওই লাল-সবুজের পতাকা যতদিন দখিনা সমীরণের দোলায় দুলবে আর পতপত করে উড়বে, ততদিন ২৩ মার্চের আনুষ্ঠানিক পতাকা উত্তোলনের গৌরবদীপ্ত মহিমা মধ্যগগনের প্রদীপ্ত সূর্যের মতো চিরকাল জাজ্বল্যমান থাকবে। এমনকি সেদিন ঢাকায় বিভিন্ন দেশের কনস্যুলেট ভবনেও স্বাধীন বাংলার পতাকা ওড়ে। যুক্তরাজ্যের ডেপুটি হাইকমিশন ও সোভিয়েত কনস্যুলেটে সকাল থেকেই স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়েছিল। চীন, ইরান, ইন্দোনেশিয়া, নেপাল নিজেদের পতাকার পাশে পাকিস্তানের পতাকা ওড়ালেও গণদাবির মুখে পরে তা নামিয়ে স্বাধীন বাংলার পতাকা তোলে। বঙ্গবন্ধু ও ইয়াহিয়ার সঙ্গে আলোচনায় যোগ দিতে আসা পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো তখন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে অবস্থা করছিলেন। তার চোখের সামনে সেই হোটেলেও উড়তে থাকে স্বাধীন বাংলার পতাকা। বিক্ষুব্ধ জনতা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের সামনে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ছবি এবং ভুট্টো ও ইয়াহিয়ার কুশপুত্তলিকা দাহ করে। প্রতিরোধ দিবস উপলক্ষে ভোর ৬টায় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে ছাত্র-জনতা প্রভাতফেরি বের করে। তারা আজিমপুর কবরস্থানে গিয়ে ভাষা শহীদ এবং সার্জেন্ট জহুরুল হকসহ বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলনে শহীদদের কবর জিয়ারত করেন। পরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পুষ্পমাল্য অর্পণ করেন।

সকাল ৯টায় আউটার স্টেডিয়ামে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে জয় বাংলা বাহিনীর আনুষ্ঠানিক কুচকাওয়াজ এবং যুদ্ধের মহড়া অনুষ্ঠিত হয়। এরপর সেখান থেকে মিছিল করে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে গিয়ে ছাত্রনেতারা বঙ্গবন্ধুর হাতে স্বাধীন বাংলার পতাকা তুলে দেন। সেদিন ঢাকা টেলিভিশনের বাঙালি কর্মীরা এক অভূতপূর্ব ও অবিস্মরণীয় সাহসিকতার পরিচয় দেন। টেলিভিশনে বাজেনি পাকিস্তানের জাতীয় সংগীত, পর্দায় ওড়েনি পাকিস্তানের পতাকা। বিকেলে মুসলিম লীগ (কাউন্সিল) প্রধান, জমিয়তে ওলামায়ে প্রধান, বেলুচিস্তান ন্যাপের সভাপতিসহ পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সংখ্যালঘু দলের নেতারা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার বাসভবনে সাক্ষাৎ করেন। সাক্ষাৎ শেষে পশ্চিম পাকিস্তানি নেতারা অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের বলেন, আমরা চাই দেশের মঙ্গলের জন্য সবকিছু খুব তাড়াতাড়ি নিষ্পত্তি হয়ে যাক। এ সময় বঙ্গবন্ধু বলেন, আপনারা ভালো কামনা করুন, কিন্তু খারাপের জন্যও প্রস্তুত থাকুন। অন্যদিকে পাকিস্তানি সামরিক সরকারও তাদের ষড়যন্ত্র চালিয়ে যেতে থাকে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানের জাতীয় দিবসের বেতার ভাষণ বাতিল করে প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে সেনানিবাসে গিয়ে সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। এ বৈঠকেই বাঙালিদের চিরতরে স্তব্ধ করার লক্ষ্যে গণহত্যার নীলনকশা চূড়ান্ত করা হয়।

এরপর আলোচনা অসমাপ্ত রেখেই ২৫ মার্চ বিকেলে গোপনে সিভিল পোশাকে ঢাকা ত্যাগ করেন জেনারেল ইয়াহিয়া। যাওয়ার আগে তিনি ঢাকায় ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর নামে গণহত্যা চালানোর নির্দেশ দিয়ে যান। সেই নির্দেশ অনুযায়ী মধ্যরাতে বর্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাঙালি জাতিকে চিরতরে স্তব্ধ করার লক্ষ্যে ঢাকাসহ সারা দেশে অতর্কিত গণহত্যা শুরু করে এবং বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারের আগে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে (২৫ মার্চ মধ্যরাতে) বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তারপর ৯ মাসের সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

add 1


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরো খবর

আজকের দিন-তারিখ

  • বৃহস্পতিবার (রাত ১২:১৮)
  • ২৬শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
  • ২৪শে জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি
  • ১১ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ (শীতকাল)

পুরাতন খবর

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০১১১২১৩
১৪১৫১৬১৭১৮১৯২০
২১২২২৩২৪২৫২৬২৭
২৮২৯৩০৩১  

Our Website Visitors Summary

  • ২৬
  • ৮৭
  • ৫৯২
  • ১,৮১৯
  • ২৫,৩৮৭
  • ৩৪,৪২৫