একযোগে দেশের বিদ্যমান বিমানবন্দরগুলোর অবকাঠামোগত ও সুবিধাদির উন্নয়নে বদলে যাচ্ছে দেশের বিমান যোগাযোগের চিত্র। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘ভৌগলিক অবস্থানের কারণে এক সময় বাংলাদেশই হবে সারা বিশ্বের যোগাযোগের হাব। কক্সবাজার বা হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, এটাই হবে আন্তর্জাতিক বিমান পরিবহনের হাব। সেটাই আমরা বিশ্বাস করি।
সেভাবেই আমরা তৈরি করতে চাচ্ছি’। গত ৭ অক্টোবর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের টার্মিনাল-৩ এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন তিনি। ‘৯৬ সালে প্রথমবার ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকারের বিমান চলাচল ও বিমানবন্দর উন্নয়ন সংক্রান্ত পদক্ষেপের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল; এ সময়টাই বিমানবন্দরের উন্নয়নের যাত্রা শুরু হয়।
১৯৯৬ সালে আমি যখন সরকারে আসি, তখন আমাদের বিমানবন্দরের কোনো বোর্ডিং ব্রিজ ছিল না, পার্কিং লট ছিল না; কিছুই ছিল না। আমরা সরকারে এসেই বিমানবন্দরের উন্নয়নের উদ্যোগ নিয়েছিলাম। চট্টগ্রাম ও সিলেট এই দুই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরও আমরা নির্মাণ করি। সঙ্গে শাহজালাল বিমানবন্দরের উন্নয়নের প্রকল্প গ্রহণ করি। ’
বাংলাদেশকে ‘এয়ার হাব’ এ পরিণত করতে যত উদ্যোগ
ব্রিটিশ আমলে এয়ার ফিল্ড হিসেবে নির্মিত বিভিন্ন বিমান অবকাঠামোকে পরবর্তীতে বিমান বন্দরে রূপান্তর করা হয়। পাকিস্তান আমলে এবং স্বাধীনতা পরবর্তী সময়েও চালু থাকা এসব বিমান বন্দর পরবর্তীতে সামরিক শাসনের সময় এবং বিএনপি শাসনামলে নানা অনিয়ম, দুর্নীতি ও অব্যাবস্থাপনার কারণে লোকসান দেখিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়।
পরে আওয়ামী লীগ শাসনে এসে একে একে এসব বিমান বন্দর চালু ও উন্নয়ন করে। এর মধ্যে রাজশাহী, সৈয়দপুর, বরিশাল ও যশোর বিমানবন্দর চালু করা হয়েছে। সিলেট ও চট্টগ্রাম বিমান বন্দরকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পরিণত করা হয়েছে।
তৃতীয় টার্মিনালেই শাহজালালের সক্ষমতা দ্বিগুণ
শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণ করা হয়েছে। টার্মিনালটি তিন তলাবিশিষ্ট। টার্মিনালের আয়তন ২ লাখ ৩০ হাজার বর্গমিটার। যাত্রী ধারণ সক্ষমতা হবে বছরে ১৬ মিলিয়ন। তৃতীয় টার্মিনালের কার পার্কিংয়ে ১ হাজার ২৩০টি গাড়ি রাখা যাবে। উড়োজাহাজ পার্কিং বে থাকবে ৩৭টি। আগমনী যাত্রীদের জন্য লাগেজ বেল্ট থাকবে ১৬টি।
বিদেশ থেকে আসা যাত্রীদের জন্য ১ হাজার ৩০০ বর্গটার আয়তনের একটি কাস্টম হল থাকবে। সেখানে ছয়টি চ্যানেল থাকবে। চেক ইন কাউন্টার থাকবে ১১৫টি, এর মধ্যে স্বয়ংক্রিয় ১৫টি। ইমিগ্রেশন কাউন্টার থাকছে ১২৮টি। এর মধ্যে স্বয়ংক্রিয় ইমেগ্রেশন কাউন্টার ১৫টি। বহির্গমন ইমিগ্রেশন কাউন্টার ৬৬টি। আগমনী ইমিগ্রেশন কাউন্টার ৫৯টি। ভিভিআইপি ৩টি।
বোর্ডিং ব্রিজ থাকবে প্রথম পর্যায়ে ১২টি বোর্ডিং ব্রিজ থাকবে। পরবর্তী সময়ে আরেকটি সম্প্রসারণ প্রকল্পের আওতায় আরও ১৪টি বোর্ডিং ব্রিজ যুক্ত করা হবে। বর্তমান টার্মিনাল দুটির সঙ্গে তৃতীয় টার্মিনালের কোনও সংযোগ থাকবে না। তবে পরবর্তী সময়ে প্রকল্পে করিডোর নির্মাণ করা হবে।
সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে আরও একটি রানওয়ে নির্মাণ করা হবে এ বিমানবন্দরে। ফুয়েলিং সুবিধা বৃদ্ধি, অপচয় রোধ এবং ব্যয় কমানোর লক্ষ্যে বিমান বন্দরের সঙ্গে সরাসরি জেট ফুয়েল পাইপলাইন সংযোগ নির্মাণ করা হচ্ছে।
বিমান বন্দরের সঙ্গে অন্যান্য যোগাযোগ সহজতর করার লক্ষ্যে রেল স্টেশন, নির্মানাধীন মেট্রোরেল স্টেশন, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের সাথে সংযোগ স্থাপন করা হচ্ছে। আন্ডারপাস নির্মাণসহ একগুচ্ছ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। দেশে নতুন রাডার নির্মাণ কাজ প্রায় শেষের পথে।
বদলে যাচ্ছে কক্সবাজার বিমানবন্দর
কক্সবাজার বিমান বন্দরকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নিত করা হচ্ছে। এর সক্ষমতা বৃদ্ধি করা হচ্ছে এবং রানওয়ে সম্প্রসারণের কাজ প্রায় শেষ পথে। এখানেও রিফুয়েলিংয়ের জন্য পাইপলাইন স্থাপন করা হবে।
বাংলাদেশে সবচেয়ে দীর্ঘ রানওয়েটি হতে যাচ্ছে কক্সবাজার বিমানবন্দরের, আর এই রানওয়ের একটি অংশ থাকবে বঙ্গোপসাগরের ভেতরে। ১০ হাজার ৭শ ফুট দীর্ঘ এই রানওয়ের তেরশ’ ফুট থাকবে সমুদ্রের মধ্যে। এটি হতে যাচ্ছে বাংলাদেশের দীর্ঘতম রানওয়ে। বর্তমানে সবচেয়ে দীর্ঘ রানওয়েটি ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের। এটির দৈর্ঘ্য ১০ হাজার ৫শ ফুট।
তৈরি করা হচ্ছে নতুন টার্মিনাল ভবন। এছাড়া বসানো হচ্ছে গ্রাউন্ড লাইটিং সিস্টেম, সেন্ট্রাল লাইন লাইট, সমুদ্র বুকের ৯০০ মিটার পর্যন্ত প্রিসিশন এপ্রোচ লাইটিং, ইন্সট্রুমেন্টাল ল্যান্ডিং সিস্টেম, নিরাপত্তা প্রাচীর নির্মাণ ও বাঁকখালী নদীর উপর সংযোগ সেতু।
অন্য আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরগুলোরও সক্ষমতা বাড়ছে
সিলেট বিমানবন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধি করা হচ্ছে। এ লক্ষ্যে ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অত্যাধুনিক নতুন টার্মিনাল নির্মাণ, রানওয়ে সম্প্রসারণ ও কার্গো স্টেশন স্থাপন করার জন্য মেগা প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে ও কাজ এগিয়ে চলেছে।
চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধি করা হয়েছে। দূর পাল্লার ফ্ল্যাইট চালু করা হয়েছে, বাড়ানো হয়েছে সুবিধা।
সৈয়দপুর বিমান বন্দরকে আঞ্চলিক বিমানবন্দরে পরিণত করতে উন্নয়ন কাজ এগিয়ে চলেছে। এর ফলে ভুটান, নেপাল ও ভারতের সেভেন সিস্টার্স খ্যাত রাজ্যগুলোর সাথে যোগাযোগ সহজতর হবে।
বিমানবন্দর উন্নিত করার অংশ হিসেবে দৃষ্টিনন্দন অভ্যন্তরীণ
টার্মিনাল ভবন নির্মাণকাজ প্রায় সমাপ্তির পর্যায়ে, রানওয়ে সম্প্রসারণ করার কাজও এগিয়ে চলেছে। পাশাপাশি বিমানের সক্ষমতাও বৃদ্ধি করা হচ্ছে। নতুন বিমান সংযোজন, দক্ষ জনবল নিয়োগ
এবং সক্ষমতা বৃদ্ধি করা হচ্ছে।
বিমানবন্দর উন্নয়ন কেন্দ্রিক আরও যত উদ্যোগ
সম্প্রতি যশোর বিমানবন্দরে নবনির্মিত আধুনিক টার্মিনাল ভবন উদ্বোধন করা হয়েছে। রাজশাহী বিমানবন্দরের অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে এবং প্রকল্প চলমান আছে। চট্টগ্রাম বিমানবন্দর থেকে দূরপাল্লার বিমান চলাচল চালু করা হয়েছে।
বরিশাল বিমানবন্দরকে আধুনিকীকরণ এর লক্ষ্যে নতুন টার্মিনাল নির্মান ও রানওয়ে সম্প্রসারণের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।
ভৌগলিক অবস্থানে সুবিধা নিয়ে বাংলাদেশ কেন ‘এয়ার হাব’ হবে
ভৌগলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ এয়ার রুটের মাঝখানে অবস্থিত। বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগর এলাকা হয়ে ভূমধ্যসাগর, প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল এবং অন্যদিকে চীন সাগর ও আন্টলান্টিক মহসাগরীয় অঞ্চলের স্থানগুলোর দিকে যেতে বাংলাদেশ মাঝামাঝি অবস্থানে রয়েছে। ইউরোপ ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর ক্ষেত্রেও একইভাবে বাংলাদেশ যাত্রা পথে মধ্য স্থানে অবস্থিত।
ফলে যাত্রা বিরতি ও রিফুয়েলিং এর জন্য বাংলাদেশ সবচেয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। এই অবস্থানটিকে কাজে লাগাতে পারলে বাংলাদেশই হবে এভিয়েশন হাব। আর সে লক্ষ্য নিয়েই এগিয়ে চলেছে বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার।
এ সব উন্নয়ন কাজ সম্পন্ন হলে বাংলাদেশ হবে বিমান সংস্থাগুলোর প্রথম পছন্দ, যা দেশকে ‘এয়ার হাব’ এ পরিণত করবে। এর ফলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিশ্রুত, ২০২৬ সাল থেকে নতুন যাত্রা করে ২০৪১ সালের মধ্যে দেশ স্মার্ট বাংলাদেশ হিসেবে পরিচিতি লাভ করবে।