ভারতের মনোভাব এখন স্পষ্ট হয়েছে। ভারত বলছে, উন্নয়নের ধারাবাহিকতা, গণতন্ত্রের স্থিতিশীলতা দরকার। এই মুহূর্তে শেখ হাসিনার কোন বিকল্প নেই। ভারত তার নিজের স্বার্থেই এ কথা বলছে। শুধু নিজের স্বার্থ না, ভারতের পক্ষ থেকে সাফ জানিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা, সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ মুক্ত উপমহাদেশ এবং বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হাত থেকে এই অঞ্চলকে মুক্ত রাখার জন্য এই মুহূর্তে শেখ হাসিনার কোন বিকল্প নেই। এই বার্তা ভারত সরাসরিভাবে দিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ নিয়ে যে খবরদারি করছে এটাও ভারত যে পছন্দ করছে না তাও সাফ জানিয়ে দিয়েছে। আজ ভারতের প্রভাবশালী গণমাধ্যম ‘আনন্দবাজার’ এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এই প্রতিবেদন প্রকাশের পরই মুখ খুলেছেন বিএনপি নেতারা। তারা বলছেন, ভারতের খবরদারি সহ্য করা হবে না।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় আজ গণমিছিলের বক্তৃতায় ভারতের তীব্র এবং কঠোর সমালোচনা করেন। একইভাবে ভারতের সমালোচনা করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির প্রভাবশালী সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী। তিনি এও বলেছেন যে, জনগণের বিরুদ্ধে যদি কোন বন্ধু দেশ অবস্থান নেয় তা হলে তারা আমাদের বন্ধু হতে পারেন না। তার এই বক্তব্য কূটনৈতিক পাড়ায় চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। কারণ আমীর খসরু মাহমুদ একজন ভারতের সাথে সহ অবস্থানের পক্ষের নেতা হিসেবে বিএনপিতে পরিচিত। তিনি যখন এইরকম অবস্থান নিয়েছেন তখন ভারত বিরোধিতা বিএনপিতে কোন পর্যায়ে গেছে তা সহজেই অনুমান করা যায়।
গত কিছুদিন ধরেই বিএনপি ভারতের সাথে সুসম্পর্ক রাখার চেষ্টা করছিল। বিশেষ করে আন্দোলনে যেন ভারত সমর্থন করে এ নিয়ে বিএনপির নেতাদের মধ্যে নানামুখী তৎপরতা ছিল দৃশ্যমান। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভারত তাদের সাড়া দেয়নি। বিএনপির কয়েকজন নেতার ভারতে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে ভারতের পক্ষ থেকে এ নিয়ে অনীহা প্রকাশ করা হয়। আর তাই এখন ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক সম্ভব নয় এই বার্তাটি পরিষ্কার হয়ে গেছে বিএনপির কাছে। এ কারণেই কি বিএনপি ভারত বিরোধী অবস্থানে গেছে।
বিভিন্ন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এখন স্বাধীনতা বিরোধী উগ্র মৌলবাদী রাজনৈতিক দলগুলোকে কাছে জানতে চাইছে বিএনপি। আর এই উগ্র মৌলবাদী রাজনৈতিক দলগুলো সবসময় ভারতবিরোধী। আর তাদেরকে কাছে টানার জন্যই কি বিএনপি এখন আবার নতুন করে ভারতবিরোধী হয়েছে?
বিএনপির জন্মই হয়েছিল ভারত বিরোধীতা করে। বাইরে ভারত বিরোধিতা আর গোপনে ভারতের পদলেহন এই নীতি ছিল বিএনপির বৈদেশিক নীতির কৌশল। এই কৌশলেই জিয়াউর রহমান এবং বেগম খালেদা জিয়া ভারতের সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের গোপন সম্পর্ক করেছেন। কিন্তু প্রকাশ্যে ভারত বিরোধিতা করেছেন। অবশ্য বিএনপির জন্মই হয়েছিল কিছু ভারত বিরোধী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের একত্রীকরণের মাধ্যমে। ভাসানীপন্থি ন্যাপ, চৈনিক বাম এবং স্বাধীনতা বিরোধী মৌলবাদী রাজনৈতিক দলগুলোকে এক প্লাটফর্মে দাঁড় করিয়েছিলেন জিয়া। তাদের সবারই একটি মিল ছিল তা হলো তারা প্রত্যেকে ভারত বিরোধী। এক সময় ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের ব্যাপক অবনতি ঘটে জিয়া সরকারের।
১৯৯১ সালে বেগম খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর আবার ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে উদ্যোগ নেয়া হয়। কিন্তু এই সময় ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীদেরকে আশ্রয় প্রশ্রয় দেন এবং প্রকাশ্য ভারত-বিরোধিতা, সংখ্যালঘু নিপীড়ণের কারণে বিএনপি ভারতের আস্থা অর্জন করতে পারেনি। বরং বিএনপি এই সময় ভারত বিরোধিতা করেই সাম্প্রদায়িক ভোট ব্যাঙ্কগুলোকে দখল করার চেষ্টা করে।
২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় এসেছিল ভারতের সাথে আপোষ করে। তারেক জিয়া ভারত সফর করেছিলেন এবং সেখানে ‘র’ এর প্রধানের কাছে সুসম্পর্কের অঙ্গীকার করেছিলেন। কিন্তু ক্ষমতায় এসে ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আশ্রয় প্রশ্রয় দেওয়া এবং আইএসআই’র পরিকল্পনা অনুযায়ী ভারতের বিরুদ্ধে কাজ করার মত তৎপরতায় জড়িয়ে পড়ে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার। উত্থান ঘটে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের। এর ফলে ভারত বিএনপি থেকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়।
গত ১৬ বছর ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য সব চেষ্টাই করেছে বিএনপি। বিএনপির পক্ষ থেকে একাধিকবার ভারতের বিভিন্ন ব্যক্তির সঙ্গে তারা সাক্ষাৎ করেছেন। কিন্তু ভারতের পক্ষ থেকে পরিষ্কার বলে দেওয়া হয়েছে যে, সন্ত্রাসীদের সঙ্গে সমঝোতা, তারেক জিয়াকে নেতৃত্ব থেকে বাদ দেওয়া এবং প্রকাশ্যে জামাতের সঙ্গ ত্যাগ ছাড়া বিএনপির সাথে ভারতের সম্পর্ক সম্ভব নয়। আর তাছাড়া এই মুহূর্তে বিএনপির নেতৃত্বে নিয়েও ভারতের মধ্যে এক ধরনের সন্দেহ সংশয় রয়েছে। বিভিন্ন সূত্র নিশ্চিত করেছে যে, ভারত কোনভাবেই তারেকের নেতৃত্ব মেনে নিতে রাজি নয়। কারণ তারেক জিয়াকে একজন সন্ত্রাসী দুর্বৃত্ত এবং আইএসআই’র এজেন্ট হিসেবে মনে করে তারা। আর এ কারণেই বিএনপি এখন নতুন করে ভারত বিরোধিতার মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক ভোটগুলোকে একত্রিত করার চেষ্টা করলো কিনা সেটাই দেখার বিষয়।