দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির প্রতিবাদ, আটক নেতা-কর্মীদের মুক্তি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার দাবিতে চলতি বছরের ১০ই জুন রাজধানী ঢাকায় অবস্থিত রমনার ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউশন মিলনায়তনে দীর্ঘ এক যুগ পর প্রকাশ্যে সমাবেশ করে জামায়াতে ইসলামী। সমাবেশ থেকে জানানো হয়, সরকার এবং সব দলকে নিয়ে আলোচনা এবং সরকার ও বিরোধীদের ‘ঐক্যের’ আহ্বান। এই ‘ঐক্যের’ মধ্য দিয়ে একটি ‘সঠিক বাংলাদেশ’ গড়ার কথাও বলে দলটি। এরপর থেকেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে ফের আলোচনায় আসে জামায়াত। এর আগে প্রায় দীর্ঘ এক যুগ জামায়াত প্রকাশ্যে কোনো সভা-সমাবেশ করা থেকে বিরত ছিল। কিন্তু সেই জামায়াত এখন আবারও নিশ্চুপ। জামায়াত চুপ থাকা মানেই হলো, দলটি যে কোনো একটা বড় কিছু করতে চায় বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, জামায়াত যখন কোনো সহিংস কর্মকাণ্ড করতে চায়, তখন হঠাৎ করেই চুপ হয়ে যায়। জামায়াতের ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করলে তাই দেখা যায়, বাংলাদেশের রাজনীতিতে জামায়াত যখনই কোনো বড় ধরনের অপতৎরতা করেছে, ঠিক তার আগ মুহূর্তে হঠাৎ করেই চুপ হয়ে গেছে। এখন এই সময়ে জামায়াত হঠাৎ চুপ কেন?- এটি অবশ্যই একটি বড় প্রশ্ন।
চলতি বছরের ২০ মার্চ বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ওই প্রতিবেদনে জামায়াতের ব্যাপারে সহানুভূতি দেখানো হয়। ওই প্রতিবেদনে অভিযোগ করা হয়, জামায়াত বাংলাদেশে কোনো সভা-সমাবেশ করতে পারছে না। এছাড়াও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে কেন্দ্র করেও বেশ কিছু প্রশ্ন তুলেছিল যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার বিষয়ক ওই প্রতিবেদন। তারই প্রেক্ষিত্রে ১০ই জুন রাজধানীতে সমাবেশ করার মৌখিক অনুমতি পায় জামায়াত। যুক্তরাষ্ট্রের ওই প্রতিবেদনে জামায়াতসহ যে সূত্রগুলো উল্লেখ করা হয়েছিল, ওই দুটি সংগঠনই অনিবন্ধিত এবং রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত নয়। ওই দুইটি সংগঠনের একটি ২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বরের সমাবেশে হতাহতের সংখ্যা নিয়ে যে তথ্য দিয়েছিল তা বিভ্রান্তিমূলক। যে কারণেই যুক্তরাষ্ট্র প্রকাশিত ওই মানবাধিকার প্রতিবেদন খুব একটা বেশি হালে পানি পায়নি। এ কারণেও জামায়াত হয়তো নিরব হতে পারে বলেই বলছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, কিছু দিন আগে একটি গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়েছিল যে, জামায়াতের আটক নেতা-কর্মীদের মুক্তির ব্যাপারে সরকারের সাথে জামায়াতের একটি সমঝোতা হয়েছে এবং সেই প্রেক্ষাপটে জামায়াত আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩শ’ আসনেই প্রার্থী দিচ্ছে। যদিও জামায়াতের নেতারা এই বিষয়টিকে অস্বীকার করেছেন, তথাপিও বিষয়টি একবারে এড়িয়ে যাওয়ার কোনো বিষয় নয়। সরকারের কাছে জামায়াতের যে ধরনের দাবি, এসব দাবি পূরণ না হলে, হয়তো জামায়াত সরকার বিরোধীদের পথেই হাটবে। যে কারণেই এই সময়ে হঠাৎ জামায়াতের চুপ থাকাটা একটি ভয়ঙ্কর পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
গত ১৪ই আগস্ট মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আমৃত্যু কারাদণ্ডপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী মারা যান। সোমবার রাত ৮টা ৪০ মিনিটে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএসএমইউ) তার মৃত্যু হয়। সে সময়ে জামায়াতের নেতা-কর্মীরা সাঈদীর মৃত্যুকে ঘিরে সারাদেশে বেশ তাণ্ডব চালায় এবং বিভিন্ন ধরনের প্রপাগাণ্ডা চালানোর চেষ্টা করে। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর পদক্ষেপ এবং সময়োপযোগী সিদ্ধান্তের কারণে সে সময়ে জামায়াত খুব একটা অস্বস্থিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারেনি। এ ঘটনার আগেও জামায়াত রীতিমতো নিরব ভূমিকায় ছিল এবং এ ঘটনার পর থেকেই আবার নিরব ভূমিকা পালন করছে দলটি। জামায়াতে এখন শুনশান নিরবতা। এই নিরবতার দুইটা কারণ হতে পারে, একটি হচ্ছে সরকারের সাথে কোনোভাবে জামায়াতের একটা সমঝোতা হয়েছিল। যে কারণেই নিরব ছিল জামায়াত। পরে সেই সমঝোতা কোনো কারণে বাস্তব না হওয়ায় সাঈদীর মৃত্যু ইস্যুকে কেন্দ্র করে আবার সরব হয়েছিল জামায়াত।
অন্যদিকে বাংলাদেশের অন্যতম মিত্র রাষ্ট্র ভারত মনে করে যে, জামায়াত একটি সাম্প্রদায়িক, সহিংস, সন্ত্রাসী রাজনৈতিক দল। বাংলাদেশে একটি সাম্প্রদায়িক দল ক্ষমতায় এলে বাংলাদেশসহ পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে একটি অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে। যে কারণেই জামায়াতের মতো সাম্প্রদায়িক দলগুলোকে যেন কোনোভাবেই আশ্রয়-প্রশ্রয় না দেওয়া হয়। এটিই হচ্ছে ভারতের বৈদেশিক নীতির একটি অভিন্ন সত্তা। সেই প্রেক্ষাপটে ভারতের যে দৃষ্টিভিঙ্গি, সে দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই হয়তো জামায়াতের প্রতি পশ্চিমা দেশুগুলোর যে সহানুভূতি, তা অনেকাংশেই নষ্ট হয়ে গেছে। যে কারণেই জামায়াত এখন আনেকটা নিরব।
কিন্তু অনেকেই শঙ্কা করছেন, সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের দিকে একটি বড় ধরনের নাশকতা, আন্দোলনের নামে সরকারে প্রতি চাপ সৃষ্টির জন্য বড় ধরনের কিছু ঘটনা ঘটানোর পরিকল্পনা এবং প্রস্তুতিতে রয়েছে জামায়াত। কারণ দেখা গেছে, জামায়াত যখনই কোনো বড় ধরনের ঘটনা ঘটায়, তার আগেই ঘাপটি মেরে যায়। যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার পরিচালনার জন্য সরকার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো, তখনও জামায়াত হঠাৎ করে সব কর্মকাণ্ড বন্ধ করে দেওয়ার জন্য নাশকতায় নেমেছিল। শাহবাগে গণজাগরন মঞ্চের যখন আন্দোলন চলছিল, তখনও জামায়াত চুপ হয়েছিল, তারপরই তারা ২০১৩ সালের ৫মে হেফাজতকে দিয়ে শাপলা চত্বরে তাণ্ডব চালিয়েছিল।
যে কারণেই অনেকেই মনে করছেন, মূলত জামায়াত একটি ভয়ঙ্কর পরিকল্পনার জন্য চুপ থাকে। এখন সামনের দিনগুলোতে বাংলাদেশে বড় ধরনের নাশকতা, রাজনৈতিক সহিংসতা, সরকারকে চাপে ফেলার জন্য, অনির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতায় আনা, -সে ধরনের একটি পরিকল্পনা নিয়েই জামায়াত চুপ হয়ে আছে কি না- সেটিই এখন দেখার বিষয়।