বাংলাদেশ : ৩৩৪/৫ (৫০.০ ওভারে)
আফগানিস্তানের কাছে দুই মাস আগে ওয়ানডে সিরিজ ১-২এ হারের ক্ষতটা শুকায়নি এখনও। তার উপর এশিয়া কাপে গ্রুপ রাউন্ডের প্রথম ম্যাচে পাল্লেকেলেতে শ্রীলঙ্কার কাছে ৫ উইকেটে হারটা বড় ধাক্কা দিয়েছে বাংলাদেশ দলকে।
এসবই সাকিবের দলকে একটু বেশিই তাঁতিয়ে দিয়েছে। নেট রান রেটে অনেক বেশি পিছিয়ে পড়ায় আফগানিস্তানের বিপক্ষে বড় জয়ের লক্ষ্য নিয়ে লাহোরে এদিন টসে জিতে ব্যাট করেছে বাংলাদেশ। তাতেই অনেক রেকর্ড দেখেছে এদিন বিশ্ব। ফগানিস্তানের বিপক্ষে এর আগে সর্বোচ্চ স্কোর ছিল বাংলাদেশের ৩০৬/৪। ২০২২ সালে চট্টগ্রামের সেই স্কোর তো বটেই, এশিয়া কাপ ইতিহাসে এতোদিন বাংলাদেশের সর্বোচ্চ স্কোর ছিল ৩২৬/৩। ২০১৪ সালে মিরপুরে পাকিস্তানের বিপক্ষে সেই রেকর্ডও ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ রোববার লাহোরে। দুই বন্ধু মিরাজ (১১২)-শান্ত’র (১০৪) সেঞ্চুরি, তৃতীয় উইকেট জুটির ১৯৪ রান এবং শেষ পাওয়ার প্লে’র ১০ ওভারে ১০৩ রানে ওয়ানডে ইতিহাসে বাংলাদেশ তৃতীয় সর্বোচ্চ ৩৩৪/৫ স্কোর করেছে এদিন।
লেগ স্পিনার রশিদ খান-অফ স্পিনার মুজিব জাদরাণ জুজুতে এদিন ভোগেনি বাংলাদেশ। এশিয়া কাপের প্রথম ম্যাচে নাঈমের সঙ্গে তানজিদ হাসান তামিমকে দিয়ে ওপেনিং করানো ঠিক হয়নি, তা অনুধাবন করে অভিষেকে ডাক-এ থেমেছে ছোট তামিমের ক্যারিয়ার। ওপেনিংয়ে নাঈমের সঙ্গে মিরাজকে নামিয়ে লাভ হয়েছে। ব্যাটিং পাওয়ার প্লে-তে এই জুটির ৬০ রানে বড় স্কোরের কক্ষপথে থেকেছে বাংলাদেশ। পাওয়ার প্লে’র শেষ বলে মুজিবকে ডিফেন্স করতে যেয়ে নাঈম শেখ বোল্ড হয়েছেন (৩২ বলে ২৮)। পরের ওভারে গুলবাদিন নাইবের বলে তাওহিদ হৃদয় দিয়েছেন স্লিপে ক্যাচ (০)। তবে পর পর দুই ওভারে ২ উইকেট পতনেও শঙ্কায় পড়তে দেননি মিরাজ-শান্ত। এক সঙ্গে দু’বন্ধু খেলছেন বয়স ভিত্তিক ক্রিকেট থেকে। খেলেছেন তারা একসঙ্গে পর পর দুটি অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ। ২০১৬ অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে বাংলাদেশ সর্বাধিক রান সংগ্রাহক (২৫৯ রান) নাজমুল হোসেন শান্ত দেখেছেন বন্ধু মেহেদি হাসান মিরাজকে (২৪২ রানও ১২ উইকেট) টুর্নামেন্ট সেরা ক্রিকেটারের পুরস্কার নিতে।এই দুই বন্ধুর পারফরমেন্সে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ ক্রিকেটে বাংলাদেশ সেবার পেয়েছে প্রথম বড় সাফল্য। বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ দলের সেবার তৃতীয় হওয়ার পেছনে এই দুই বন্ধুর পারফরমেন্স হয়েছে প্রশংসিত।
ওই পারফরমেন্সেই জাতীয় দলের দরজায় কড়া নেড়েছেন দুই বন্ধু। তিন মাসের ব্যবধানে অভিষেক হয়েছে সমবয়সী দুই বন্ধুর। তবে বন্ধু মিরাজ যখন টেস্টে নিয়মিত, অন্য দুই ফরম্যাটে দলে আসা-যাওয়ার মধ্যে, তখন আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের শুরুতে প্রত্যাশিত পারফর্ম করতে না পারায় শান্তকে জাতীয় দলে থিতু হতে অপেক্ষা করতে হয়েছে। তাই ব্যাটিং পার্টনার হিসেবে টপ অর্ডার শান্ত’কে পাননি লোয়ার অর্ডার মিরাজ। রোববার ব্যাটিং অর্ডার পরিবর্তন হয়েছে। ৭ নম্বর থেকে মিরাজকে প্রমোশন দেয়া হয়েছে ওপেনিংয়ে। শান্ত সেখানে ৩ থেকে নেমে গেছেন ৪ নম্বরে। কাকতালীয়ভাবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে রোববার মিরাজকে শুরু থেকে পার্টনার হিসেবে পেয়েছেন শান্ত। তাতেই দুই বন্ধুর দারুণ বোঝাপড়া দেখেছে বিশ্ব।
তৃতীয় উইকেট জুটিতে একটার পর একটা মাইলস্টেন করেছেন তারা। দু’বন্ধু পেয়েছেন সেঞ্চুরির দেখা। দু’জনেই উদযাপন করেছেন ওডিআই ক্যারিয়ারে দ্বিতীয় সেঞ্চুরি। মিরাজ ৭৯ ম্যাচে দ্বিতীয় তো শান্ত ২৯ ম্যাচে দ্বিতীয়! বোঝাপড়ার ইনিংসে একটার পর একটা মাইলস্টোনে পা দিয়েছেন তারা। ১০০ রান পূর্ণ করেছেন তারা ১১৭ বলে। সেঞ্চুরি পার্টনারশিপে শান্ত’র চেয়েও মিরাজের অবদান ছিল বেশি। শান্ত যেখানে ১০০ রানের পার্টনারশিপে ৫৬ বলে করেছেন ৪৬, সেখানে মিরাজ ৬১ বলে ৫২।
এশিয়া কাপ ক্রিকেটে এতোদিন তৃতীয় উইকেট জুটিতে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ ছিল ১৩৩ রান। ২০১৪ সালে ফতুল্লায় মুশফিক-বিজয় করেছিলেন সেই পার্টনারশিপটি। এশিয়া কাপে যে কোনো জুটিতে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ ছিল ইতোপূর্বে ১৬০ রান। শ্রীলঙ্কার ডাম্বুলায় ২০১০ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে জুনায়েদ-ইমরুল করেছিলেন সেই রেকর্ড। সেই দুটি রেকর্ডকে টপকে গেছেন রোববার মিরাজ-শান্ত।আফগানিস্তানের বিপক্ষে তৃতীয় উইকেট জুটিতে এতোদিন সর্বোচ্চ ছিল ২০২। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে লিটন-মুশফিক চট্টগ্রামে করেছিলেন এই পার্টনারশিপ। সেই রেকর্ডকে টপকে যাওয়ার হাতছানি ছিল লাহোরে। তবে ডেথ ওভারে বিগ শটের প্রয়োজনে মুশফিককে উইকেটে এনে ফিরে গেছেন মিরাজ ড্রেসিংরুমে। তাতে পার্টনারশিপ থেমেছে ১৯৪-এ। ১৯০ বলের এই পার্টনারশিপে মিরাজের অবদান ৯১ বলে ৯১, শান্ত’র ১০০ বলে ৯৯। ফিরে যাওয়ার আগে মিরাজ নিজে স্কোর কার্ডে জমা করে গেছেন ১১২ বলে ৭ চার, ৩ ছক্কায় ৯৪.১১ স্ট্রাইক রেটে ১১২ রান।
গত বছরের ডিসেম্বরে মিরপুরে ওডিআই ক্যারিয়ারের প্রথম সেঞ্চুরি উদযাপন করেছেন মিরাজ ৮ নম্বরে ব্যাট করে। ৮৩ বলে ৮ চার, ৪ ছক্কায় শোভিত সেই হার না মানা সেঞ্চুরিতে ভারতকে হারিয়ে ওয়ানডে সিরিজ জয়ের উৎসব করেছে বাংলাদেশ দল। ওডিআই ক্রিকেটে যে দুটি হাফ সেঞ্চুরি করেছেন মিরাজ এর আগে, সেই দুটিই ৮ নম্বরে। ২০১৭ সালে কলম্বোর প্রেমাদাসায় শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ৭১ বলে ৫১, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে চট্টগ্রামে আফগানিস্তানের বিপক্ষে ১২০ বলে ৮০ রানের অবিচ্ছিন্ন সেই ইনিংসটি ৮ নম্বরে নেমে করেছেন। এর আগে একবারই মাত্র নেমেছিলেন ওপেনিংয়ে। ২০১৮ সালে দুবাইয়ে এশিয়া কাপের ফাইনালে ওপেনিংয়ে নেমে ভারতের বিপক্ষে ৩২ রানের ইনিংসে পেয়েছেন মিরাজ হাততালি। ওডিআই ক্যারিয়ারে ৭৯তম ম্যাচে এসে দেখা পেলেন দ্বিতীয় সেঞ্চুরির। গুলবাদিন নাইবকে মিড অনে সিঙ্গল নিয়ে পূর্ণ করেছেন সেঞ্চুরি। যে সেঞ্চুরিতে খেলেছেন তিনি ১১৫টি বল। মেরেছেন ৬টি বাউন্ডারির পাশে মোহাম্মদ নবীকে ডাউন দ্য উইকেটে এবং মুজিব জাদরানকে দর্শণীয় সুইপে ছক্কা!
মুজিব জাদরানকে এক্সট্রা কভারে ছক্কা মেরে, শান্ত’র সেঞ্চুরি দেখে থেমেছেন মিরাজ। পাল্লেকেলেতে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ৮৯ রানের পর লাহোরেও শান্ত’র চওড়া ব্যাট দেখেছে দর্শক। চেম্পসফোর্ডে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে ওডিআই ক্যারিয়ারে প্রথম সেঞ্চুরির (১১৭) পর হোমে আফগানিস্তানের বিপক্ষে সিরিজটি ছিল শান্ত’র হতাশার। চট্টগ্রামে ইনিংস তিনটি ১২,১,১১। এই হতাশা কাটিয়ে আফগানিস্তােনের বিপক্ষে মুজিব জাদরানকে ফ্লিক শটে সিঙ্গল নিয়ে ১০১ বলে ৯ চার, ২ ছক্কায় ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় ওয়ানডে সেঞ্চুরি পূর্ণ করেছেন শান্ত।নিজের ২৫তম জন্মদিনে প্রথম সন্তানের জন্ম। ৯ দিন বয়সী নবজাতকে সেঞ্চুরি উৎসর্গ করতে পেরেছেণ শান্ত। ক্যারিয়ারসেরা ইনিংসের সম্ভাবনাও ছিল তার। তবে ভাগ্যটা খারাপ। গুলবাদিনকে সিঙ্গল নিতে যেয়ে পা পিছলে হাফ পিচে পড়ে রান আউটে থেমেছেন শান্ত। তবে রান আউটে কাটা পড়ার আগে করেছেন ১০৫ বলে ৯ চার, ২ ছক্কায় ১০৪ রান। ব্যাট চওড়া করে রান আউটে থেমেছেন মুশফিকও (১৫ বলে ১ বাউন্ডারি, ১ ছক্কায় ২৫)। ডেথ ওভারে সাকিবের ব্যাটটাও ছিল চওড়া (১৮ বলে ৪ বাউন্ডারিতে ৩২*)। এদিন লেগ স্পিনার রশিদ খানকে পাড়া মহল্লা মানে নামিয়ে এনেছে বাংলাদেশ বোলাররা (১০-০-৬৬-০)। মুজিব জাদরানের জারিজুরির জবাব দিয়েছে (১০-০-৬২-১)।