এই তো ক’দিন পর ১৪২৬ বঙ্গাব্দের আওতায় শুভ নববর্ষ পালিত হতে যাচ্ছে। এ প্রেক্ষাপটে বর্ষবরণ, হালখাতা, মেলা, আচার ভিত্তিক সামাজিক উৎসবসহ নানা কার্যক্রম অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। এটা বাংলার সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সাথে মিশে গেছে। কিন্তু এখানেই শেষ নয়। আর একটি বিশেষ উপাদান এর সাথে যোগ হয়েছে। তা হলো “পান্তা ভাত”। তাই পান্তা ভাত নিয়ে কিছু কথা বলতে প্রয়াসী হয়েছি। উল্লেখ্য যে, গ্রাম বাংলার খাদ্য সংস্কৃতির (Food Culture) অন্যতম প্রধান নিয়ামক হলো পান্তা ভাত (Watered Rice)। এদিকে “পান্তা ভাত” কথাটি আমাদের শিল্প-সাহিত্যের অঙ্গনেও রয়েছে অবাধ বিচরণ; যেমন- কল্প কাহিনি হিসেবে “পান্তা বুড়ি” এবং জনপ্রিয় ছড়া “ঐ দেখা যায় তাল গাছ… ও বগি তুই চাস কি, পান্তা ভাত খাস কি”? ইত্যাদি। তাছাড়া কৌতুকের দৃষ্টিকোণ থেকে কিছু প্রবচন প্রচলিত আছে; যেমন “কিসের ভেতর কি; পান্তা ভাতে ঘি”। এতদ্ব্যতীত গ্রাম বাংলার ছন্দকারে একটি মজার গল্প প্রায় জনপদে শুনা যায়। সেক্ষেত্রে উল্লেখ্য যে, কোন একটি পরিবারের স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে অমিল। সেহেতু স্ত্রী স্বামীকে খুব ভাল চোখে দেখে না বিধায় তার সাথে প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ড করতো। এরই আবর্তে অন্যান্য কার্যক্রমসহ খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে স্বামীকে এ মর্মে ঠকাতো যে, স্ত্রী গরম খাবার খেয়ে স্বামীকে পান্তা ভাতসহ বাসী খাদ্য দ্রব্য খাওয়াতো। এই ভাবে চলতে থাকলেও একদিন ধরা পড়ে যায়। এটাকে অমূলক করতে স্বামীকে শুনিয়ে স্ত্রী নিম্নোক্ত ছড়াটি বলে: “পান্তা ভাতের জল, যেন তিন মরদের বল; “আমি অভাগী গরম খাই, কখন যেন মরে যাই।”
এই ছড়াটির সূত্র ধরে উল্লেখ্য যে, সাধারণ মানুষের মধ্যে এই মর্মে বিশ্বাস যে গরম খাবার তুলনামূলক উত্তম, যা পরিবারের উপরের দিকের সদস্যেরা খেয়ে বাঁচলে নি¤œস্তরের সদস্যেরা খেয়ে থাকে। আর তাই উক্ত স্ত্রী সেটা মনে প্রাণে বিশ্বাস করতো বলেই অবশিষ্ট পানি দেয়া পান্তা ভাত অপ্রিয় স্বামীকে খাওয়াতো। আর যে দিন সরল সোজা স্বামীর কাছে এই অনাহুত কর্মকাণ্ড ধরা পড়ে যায়। তখন উক্ত ছড়ার পক্তির মাধ্যমে পরোক্ষভাবে ছলনাপূর্বক স্বামীর প্রতি গভীর ভালোবাসার আতিশয্য প্রকাশ করে। যাহোক, পান্তা ভাতকে ঘিরে নেতিবাচক কথার অভাব নেই। কেননা প্রায় ক্ষেত্রে অতি তুচ্ছ বিষয় বুঝাতে পান্তা ভাত কথাটি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। আবার এ সারথি ধরে এও কথা বিভিন্ন জনপদে শুনা যায়- “আরে এ কাজটি পারবি না, এতো খুবই সহজ, যেন পান্তা ভাত”? এটা সর্বজনবিদিত যে, পান্তা ভাত তৈরিতে বলতে গেলে বাড়তি সময় ও খরচ লাগে না। আর যত কথাই বলি না কেন, পান্তা ভাত উপকারী কম নয়? মূলত পান্তা ভাত হলো ভাত সংরক্ষণের একটি সনাতনী পদ্ধতি। পূর্বেই বলেছি, রাতে খাবারের পর বেঁচে যাওয়া অবশিষ্ট ভাতে পরিমাণ মতো পানিতে ডুবিয়ে রাখলেই পান্তায় পরিণত হয়ে থাকে। হয়ত অনেকেই অবহিত আছেন যে, ফুড ভ্যালু হিসেবে ভাতে শর্করা বিদ্যমান। সেহেতু পানিতে থাকলে নানা ধরনের গাজনকারী ব্যাক্টেরিয়া বা ইস্ট এই শর্করা ভেঙ্গে ইথানল এবং ল্যাকটিক অ্যাসিড তৈরির পথ সুগম করে থাকে। আর এই ল্যাকটিক তৈরির সুবাদে পান্তা ভাতে অম্লত্ব (Acidity) বৃদ্ধি পায়, যা প্রকারান্তরে ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাক হতে নষ্ট হওয়া থেকে রক্ষা করে থাকে।
আর একটি কথা, আমরা সাধারণত পান্তা ভাতের চেয়ে গরম ভাতকে অধিকতর অগ্রাধিকার দিয়ে থাকি। কিন্তু সবক্ষেত্রেই এটি প্রযোজ্য নয় বলে প্রতীয়মান হয়। আসলে পান্তা ভাত হলো পানিতে ভিজিয়ে রাখা ভাত। পান্তা ভাত কথাটি এলেই প্রথমেই গ্রাম বাংলার কথা মনে করিয়ে দেয়। আমাদের কৃষি নির্ভরশীল অর্থনীতিতে গ্রাম বাংলা বলতে গেলে আদি গোড়া বা নিউক্লিয়াস। এখানে কৃষি ভিত্তিক পরিবারে সাংসারিক কাজে কিষাণীরা কাক ডাকা ভোর থেকে গভীর রাত অবধি নানা রকম কাজের মধ্যে ব্যতিব্যস্ত থাকতে হয়। সাধারণত খাবার সংস্কৃতিতে তিনবেলা খাবারের ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে; যেমন- সকালের নাস্তা, দুপুরের খাবার এবং রাত্রের খাবার। তাই কিষাণীদের খাবার তৈরির জন্য উল্লেখযোগ্য সময় ব্যয় করতে হয়। এ প্রেক্ষাপটে যদি তিন বেলার খাবারের আওতায় যদি দু’বেলার জন্য তৈরি করা হয়, তাহলে একদিকে সময় বেঁচে যায়; অন্যদিকে জ্বালানীসহ অন্যান্য খরচও তুলনামূলক কম পড়ে। এ সূত্র ধরে উল্লেখ্য যে, রাতের বেলার খাবারের জন্য যতখানি চাউল প্রয়োজন, তাসহ সকালের নাস্তা বা খাবারের পরিমাণ নির্ধারণ করে কিষাণী রাত্রে অধিক ভাত পাক করে থাকে। আর রাত্রে খাওয়ার পর যতটুকু অবশিষ্ট থাকে, পরিমাণ মতো পানিতে ডুবিয়ে রাখে। অবশ্য, শীতকালে এটি প্রযোজ্য নয়। কেননা তখন ঠাণ্ডার সুবাদে আর সংরক্ষণ করতে পানির প্রয়োজন হয় না।
এবার আসুন, বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে পান্তা ও গরম ভাত নিয়ে তুলনামূলক কিছুটা আলোচনা করা যাক। এ প্রেক্ষাপটে উল্লেখ্য যে, ১০০ গ্রাম গরম ভাতে ৩.৪ মিলিগ্রাম আয়রন থাকে; সেখানে সেই পরিমাণ ভাত ১২ ঘণ্টা পানিতে রাখার পর ৭৩.৯১ মিলিগ্রাম আয়রন পাওয়া যায়। আবার ১০০ গ্রাম পরিমাণ গরম ভাতে ক্যালসিয়াম থাকে ২১ মিলিগ্রাম। অথচ একই পরিমাণ পান্তা ভাতে পটাসিয়াম ও ক্যালসিয়ামের পরিমাণ বেড়ে যথাক্রমে ৮৩৯ এবং ৮৫০ মিলিগ্রামে দাঁড়ায়। এদিকে গরম ভাতে সোডিয়ামের পরিমাণ ৪৭৫ মিলিগ্রাম থাকে। কিন্তু পানিতে ডুবানোর পর তা হ্রাস পেয়ে ৩০৩ মিলিগ্রাম হয়ে থাকে। এটা সত্য যে, পান্তা ভাত শর্করা সমৃদ্ধ আকর্ষণীয় খাবার বিধায় এ ভাত ভিটামিন বি-৬ এবং ভিটামিন-১২ এর একটি নির্ভরযোগ্য উৎস। তাছাড়া পান্তা ভাত গাঁজানো (Fermented) জলীয় খাবার। তাই এ ভাত খেলে তুলনামূলক অধিক শক্তি পাওয়া যায়। গরমের দিনে এর তুলনা মিলা ভার এবং একই সাথে দেহের তাপের ভারসাম্য বজায় রাখে। আর একটি কথা, গরম ভাতের তুলনায় পান্তা ভাতে অনেক উপকারী ব্যাক্টেরিয়া পাওয়া যায়। তবে পান্তা ভাত অধিক কাল পানিতে রাখলে মদের ন্যায় বৈশিষ্ট্য সৃষ্টি হওয়ার বিষয়টি উড়িয়ে দেয়া যায় না। আর এটা মাথায় রেখে বাংলাদেশের অনেক স্থানে এই ভাবে মদ তৈরি করা হয়, যা বাংলা মদ হিসেবে অভিহিত।
পান্তা ভাত এমনিই মজা, তার উপর যদি কাঁচা বা শুকানো মরিচ ও পিঁয়াজ হয়, তাহলে তো কথাই নেই। এ ছাড়াও যদি আরও কিছুটা আইটেম হিসেবে ভর্তা ও মাছ ভাজা যোগ হয়, তাহলে তো কাচ্চি বিরানিও হার মানে। এখানেই শেষ নয়, আসল জিনিসটির কথা তো বলাই হয়নি? এতক্ষণ বোধ হয় কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছেন, কি বলতে চাচ্ছি। যাহোক, আমিই নিজেই বলছি, সেটা হলো আমাদের জাতীয় মাছ ইলিশের দু’এক পিস। আর এতে তখনই বোধ হয় শত ভাগ পূরণ হয়। এই সূত্র ধরে বাংলা নববর্ষের (১লা বৈশাখ) কথা এসে যায়। সেই সময়ে পান্তা ভাত ও ইলিশ সংক্ষেপে “পান্তা-ইলিশ” না খেলে নাকি পুরোপুরি নববর্ষ পালনের কমতি থেকে যায়। এক্ষেত্রে পান্তা ইলিশের আদি গোড়ার কথা জানা আবশ্যক বলে মনে করি। এ প্রেক্ষাপটে উল্লেখ যে, ১৯৮৩ সালে চৈত্রের শেষে যখন রমনা বটমূলে বৈশাখ বরণের আয়োজন চলছিল। তখন কয়েকজন উঠতি বয়সের ছেলেরা আড্ডা দিতে দিতে পান্তা-পেঁয়াজ-কাঁচা মরিচের কথা তোলেন। আর তাঁদের মধ্যে একজন বটমূলে পান্তা-ইলিশ চালুর প্রস্তাব দেন। তখন তাঁদের মধ্যে এ প্রস্তাবটি গৃহীত হয়। এ সূত্র ধরে তাঁদের নিজেদের ভেতর থেকে পাঁচ টাকা করে চাঁদা তোলা হয়। তৎপর রাতে ভাত রেঁধে পান্তা তৈরিপূর্বক কাঁচা মরিচ, শুকনো মরিচ, পেঁয়াজ এবং ইলিশ মাছ ভাজাসহ ভোরে ঠিকই কথা মতো তাঁরা প্রথমে বটমূল এবং পরে রমনা রেস্টুরেন্টের সামনে হাজির হন। তাঁদের সাথে মাটির সানকিও ছিল। মুহূর্তের মধ্যে শেষ হয়ে যায় পান্তা-ইলিশ। সেই থেকে বর্ষবরণের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক পান্তা-ইলিশের পদচারণা শুরু হয়। আর এখন তো ফরমাল রেওয়াজ হয়ে পান্তা ইলিশ পহেলা বৈশাখের পার্ট এন্ড পার্সেল হয়ে দাঁড়িয়েছে।
মজার ব্যাপার হলো পান্তা ইলিশ এমনই আর্কষণীয় আইটেম হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, কেবল রাজধানী নয়। সারা বাংলাদেশের বড় বড় মেলায় স্থাপিত স্টলে পান্তা ইলিশ ব্যাপক ভাবে বিক্রি হয়ে থাকে। ১লা বৈশাখে পান্তা ইলিশ বিক্রির বিষয়টি প্রণিধানযোগ্য। কেননা এটি দিনে দিনে বেড়ে চলেছে। আর এর জনপ্রিয়তা দেখে মনে হয় আগামীতে হয়ত উৎসব অর্থনীতির বড় একটা প্যারামিটার হয়ে দাঁড়াবে। তাছাড়া অনেক সংস্কৃতিমনা পরিবারেও পান্তা ইলিশের আয়োজন করা হয়ে থাকে। অতীব দুঃখের বিষয় এই যে ‘পান্তা ভাত’ কথাটি অতি তুচ্ছ শব্দ হিসেবে আমাদের আলাপ চারিতা সংস্কৃতিতে বহমান, যা কিছুটা পূর্বেই উল্লেখ করেছি। এদিকে পান্তা ভাত অন্য খাদ্যদ্রব্য পাকের মতো তেমন কোন সমস্যা হয় না। কেবল গৃহিণী বা কিষাণী ইচ্ছে করলেই অতি সহজে হয়ে যায়। এ নিয়ে একটি বাস্তব মজার কাহিনি আছে, যা আমি বাংলা একাডেমির জনৈক কর্মকর্তার কাছ থেকে শুনেছি। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য যে বাংলাদেশের খ্যাতনামা একজন প্রযোজক, পরিচালক ও অভিনেতা বিলেতে থাকাকালীন সময়ে একজন মেম সাহেবকে বিয়ে করেন এবং দেশে ফিরে আসার সময় ঐ স্ত্রী (মেম সাহেব) কে সাথে করে নিয়ে আসেন। দেশে এসে তাঁরা ভাল ভাবেই কালতিপাত করছিলেন।
এদিকে অল্প সময়ের মধ্যে মেমসাহেব স্বামীর আত্মীয় স্বজনের মন জয় করে ফেলেন। কিন্তু এ্যাডজাস্টমেন্টের প্রশ্নে স্বামীর মন পুরোপুরি জয় করতে না পারায় স্বামী স্থির করেন যে তাঁকে বিলেতে ফেরত পাঠিয়ে আর একটি বিয়ে করবেন। তখন তাঁর আত্মীয় স্বজন উক্ত অভিনেতাকে বলেন, “মেম সাহেব (স্ত্রী) তো ভাল। কেন তাঁকে বিলেতে পাঠিয়ে দিবে”? তখন অভিনেতা স্বামী বলেন “ও তো পাক-টাকসহ সংসারের কোন কাজ তেমন করতে পারে না”। তখন মেম সাহেব সেখানে উপস্থিত ছিলেন এবং বলেন যে, “কেন, আমি তো পান্তা ভাত পাক করতে পারি? এক্ষেত্রে আমি এই কথাটি বুঝাতে চাচ্ছি যে আরও তো অনেক কিছু ছিল? কিন্তু মেম সাহেব কেন শুধু পান্তা ভাতের কথা বলেছেন? এতে প্রতীয়মান হয় যে মেম সাহেবের মনে পান্তা ভাতের বিষয়টি অধিক দাগ কেটেছিল এবং একই সাথে স্বাদের পান্তা ভাত তৈরি প্রণালীতে তেমন কোন কায়-ক্লেশ নেই বিধায় হয়ত তিনি আকর্ষিত হয়েছিলেন।
আর একটি কথা, সব চালের পান্তা ভাত স্বাদের নয়। আউশ বা আমনের চালের পান্তা ভাত বাঙালিদের কাছে অমৃতসূলভ। আবার পুরাতন চালের চেয়ে নতুন চালে পান্তা ভাত আরও সুস্বাদু হয়। অথচ বর্তমানে আউশ ও আমন বিরল হয়ে দাঁড়িয়েছে। এদিকে পরিবর্তনশীল রুচি সহ আধুনিকতার নামে গ্রাম বাংলার সেই সকাল বেলার নাস্তা হিসেবে পান্তা ভাতের সংস্কৃতি দিনে দিনে কোণঠাসা হয়ে পড়ছে। এক্ষেত্রে যে বিষয়টি আমার মনের আঙ্গিনায় উঁকিঝুঁকি দেয়; তাহলো, যেভাবে সামাজিক ভাবধারা ও মননশীলতা পরিবর্তিত হচ্ছে, হয়ত সেদিন বেশী দূরে নয়; যখন পান্তা ভাতের সংস্কৃতি বাংলা নববর্ষ তথা ১লা বৈশাখ ছাড়া অন্য কোন সময় পাওয়া দুরূহ ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। পরিশেষে জনৈক কবি’র কবিতার প্রথম চার লাইন দিয়ে পরিসমাপ্তি টানছি: “পান্তা ভাতের যে অমৃতসূলভ ঝোল; `সদা তনু-মনে দেয় অভাবনীয় দোল। `জর্দা, পোলাও ও কাচ্চি বিরিয়ানি হেরি; বেলা গড়ে যায় হে মনা খাও তাড়াতাড়ি।” মো. আব্দুল বাকী চৌধুরী নবাব: বিশিষ্ট গবেষক, অথর্নীতিবিদ এবং লেখক