ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে খ্যাত পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবন। মৎস্য ও বন সম্পদের প্রাচুর্যে ভরপুর এই বনভূমিতে আশির দশকে জলদস্যুরা সুন্দরবনের বিভিন্ন পেশাজীবীদের খুন, অপহরণ, ডাকাতি, চাঁদাবাজি, মুক্তিপণ আদায়সহ নির্যাতন ও নীপিড়নের মাধ্যমে ভয়ংকর রূপ ধারণ করে। গহীন সুন্দরবনের পুরো অঞ্চল জুড়েই ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করে সেখানে শক্ত ঘাঁটি গেড়ে বসেছিল জলদস্যুরা।
সুন্দরবনের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনরক্ষা, মৎস ও বনজ সম্পদের সংরক্ষণ সর্বোপরি সুন্দরবনকে বাঁচাতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ২০১২ সালে র্যাব ফোর্সেসকে লিড এ্যাজেন্সি করে তৈরি হয় টাস্কফোর্স। একের পর এক র্যাবের দুঃসাহসিক অভিযানে দিশেহারা হয়ে জলদস্যুরা উপায়ান্ত না দেখে আত্মসমর্পণের সুযোগ খুঁজতে থাকে। কোনঠাসা হয়ে পড়া জলদস্যুরা আত্মসমর্পনের সুযোগ চাইলে প্রধানমন্ত্রীর দিক নির্দেশনা ও র্যাব ফোর্সেস এর সার্বিক ব্যবস্থাপনায় ২০১৬ সালের ৩১ মে হতে ১ নভেম্বর ২০১৮ পর্যন্ত সুন্দরবনের ৩২টি দস্যু বাহিনীর ৩২৮ জন সদস্য ৪৬২টি অস্ত্র ও বিপুল পরিমাণ গোলাবারুদসহ আত্মসমর্পণ করে।
র্যাব ফোর্সেস এর লোমহর্ষক অভিযানে সুন্দরবন সম্পূর্ণরুপে দস্যুমুক্ত হওয়ায় প্রধানমন্ত্রী ১ নভেম্বর ২০১৮ তারিখে সুন্দরবনকে জলদস্যুমুক্ত করার ঐতিহাসিক ঘোষণা প্রদান করেন। আত্মসমর্পণকৃত জলদস্যুদের পুনর্বাসনের মাধ্যমে সমাজের মূল ধারায় ফিরিয়ে নিয়ে এসে পুনর্বাসনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর তহবিল হতে প্রত্যেককে নগদ ১ লক্ষ টাকা, র্যাব ফোর্সেস এর পক্ষ থেকে নগদ ২০ হাজার টাকা ও ১টি করে মোবাইল সেট প্রদান করা হয়।
পরবর্তীতে আত্মসমর্পণকারীদের উপর পুনর্বাসন চাহিদা নিরুপণ করে দস্যুমুক্ত সুন্দরবন ঘোষণার ৩য় বর্ষপূর্তিতে আত্মসমর্পণকারীদের মাঝে ১০২টি ঘর, ৯০টি মালামালসহ মুদি দোকান, ২২৮টি গবাদি পশু, ১২টি মাছ ধরার নৌকা ও জাল, ৮টি ইঞ্জিন চালিত নৌকা বিতরণ করা হয়। মাওয়ালি, বাওয়ালি, বনজীবী, মৎসজীবীসহ দুবলার চরে আগত পর্যটকরা প্রায়ঃশই চরম স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ে থাকেন। জনবিচ্ছিন্ন বালুময় এ চরে ছোট ছোট কুপ খনন করে সেখান থেকে পানি তুলে স্থানীয়দের ব্যবহার করতে হয় যা স্বাস্থ্য সম্মত নয়। দুবলার চর এলাকায় বিশুদ্ধ পানির অপ্রতুলতা থাকায় র্যাব উদ্যোগী হয়ে এই সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসে। এ প্রেক্ষিতে দুবলার চরে বিশুদ্ধ ও সুপেয় পানির ব্যবস্থা করার লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় র্যাব ফোর্সেস এর তত্ত্বাবধানে সুন্দরবনের দুবলার চরে বিশুদ্ধ ও সুপেয় পানির জন্য ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট স্থাপনের কার্যক্রম শুরু করা হয়। দুবলার চর এলাকার পানিতে অতিমাত্রার লবণাক্ততা পরিলক্ষিত হয় এবং পানির লেয়ার অনেক নীচু হওয়ায় দক্ষ ইঞ্জিনিয়ারদের সহায়তায় কয়েক বারের চেষ্ঠায় এই পানি পরিশোধনাগার স্থাপন করা হচ্ছে।
এ প্রেক্ষিতে র্যাব ফোর্সেস এর অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন্স) কর্নেল মো.মাহাবুব আলম সাম্প্রতিক সময়ে ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট স্থাপন কার্যক্রমের অগ্রগতি পর্যালোচনা করতে সুন্দরবনের দুবলার চর পরিদর্শন করেন। উক্ত পরিদর্শনে র্যাব ফোর্সেস সদর দপ্তরের অন্যান্য উর্ধ্বতন কর্মকতারা বনবিভাগের কর্মকর্তারা স্থানীয় জনপ্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিগণও উপস্থিত ছিলেন।
প্রতিবছরের ন্যায় এ বছরও নভেম্বর মাসে দুবলার চর কেন্দ্রীক হিন্দুদের রাশ উৎসব অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। এই রাশ মেলায় আগত পুণ্যার্থী ও পর্যটকদের উপস্থিতিতে আগামী ২৬ নভেম্বর র্যাব ফোর্সেসের মহাপরিচালক অতিরিক্ত আইজিপি এম খুরশীদ হোসেনের ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট উদ্বোধনের কথা রয়েছে। দুবলার চরে ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট স্থাপনের মাধ্যমে দুবলার চর ও এর আশেপাশের এলাকার মৎসজীবীসহ অন্যান্য পেশাজীবী, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, ব্যবসায়ী, পুণ্যার্থী, পর্যটক ও সাধারণ মানুষজনের বিশুদ্ধ ও সুপেয় পানির সংকট দূর করা সম্ভব হবে। উন্নত মানের এই ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্টের মাধ্যমে প্রতিদিন গড়ে চব্বিশ হাজার লিটার পানি পরিশোধন করা যাবে। পানি সংগ্রহের স্থান হতে ১৫টি ডিস্ট্রিবিউশন পয়েন্টের মাধ্যমে প্রায় লক্ষাধিক মানুষ বিশুদ্ধ ও সুপেয় পানির সুবিধা ভোগ করবেন। ইতিপূর্বে র্যাবই সুন্দরবনকে দস্যুমুক্ত করে সুন্দরবন ও এর আশেপাশের এলাকায় শান্তি প্রতিষ্ঠা করেছে। দুবলার চরবাসীদের জন্য বিশুদ্ধ ও সুপেয় পানির ব্যবস্থাকরণে র্যাব ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট স্থাপন করে পুনরায় দৃষ্টান্ত স্থাপন করলো।